অধ্যায় ১ — আগমন
রাত তখন প্রায় তিনটা।
মাঘের শেষ দিক। হিমেল হাওয়া গায়ে ছুরি চালাচ্ছে।
গ্রামের নাম নবনগর—নামটা আধুনিক, কিন্তু বাতাসে এখনো গরুর ঘ্রাণ, কুয়াশা আর নিরবতা।
দূরের রাস্তা দিয়ে একজন লোক হেঁটে আসছে।
হাতে মোবাইলের টর্চলাইট, কাঁধে পুরনো ব্যাগ।
বয়স আনুমানিক চল্লিশের কাছাকাছি, মুখে দাড়ি, চোখে অদ্ভুত এক শান্ত হিংস্রতা।
লোকটার নাম মজিদুল হক।
এক সময় ঢাকায় ছিল।
এক রাজনৈতিক দলের অনলাইন মিডিয়া সেলে কাজ করত—ভিডিও বানাত, পোস্ট দিত, মানুষের মগজে ভয় ঢুকিয়ে ভোটের স্লোগান গুঁজে দিত।
তার হাতেই তৈরি হয়েছিল “দেশপ্রেম মানেই নেতার নাম” টাইপ ভিডিও।
একদিন ভুল করে অন্য দলের এক ভিডিও নিজের পেজে শেয়ার করেছিল।
ভুলটা এত বড় অপরাধ হয়ে দাঁড়ালো যে, পরদিনই তাকে “অবিশ্বস্ত” ঘোষণা করে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়।
তারপর থেকে সে অদৃশ্য।
বন্ধু নেই, আড্ডা নেই, শুধু ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ।
একদিন রাতে সে হঠাৎ ঠিক করে—
মানুষের ভয়ই সবচেয়ে বড় পুঁজি।
যে ভয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে-ই রাজা।
রাজনীতিতে সেটা করে দল, ধর্মে করে পীর।
সে ব্যাগে একটা লাল কাপড় রাখে,
আর বেরিয়ে পড়ে এক গ্রামে, যেখানে এখনো মানুষ বিশ্বাসে বাঁচে আর অজানায় ভয় পায়।
নবনগরে পৌঁছে সে দেখে, রাস্তার পাশে একটা পুরনো কবর, গাছের নিচে পড়ে আছে—
অলক্ষ্যে, ধুলোয়, ভুলে যাওয়া।
কোনো নাম লেখা নেই, শুধু একটা ভাঙা পাথর, তাতে ক্ষয়ে যাওয়া আরবি হরফ।
সে বসে পড়ে কবরের পাশে।
মোবাইলের আলো নিভিয়ে দেয়,
আর বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ শুনে মনে হয়, কেউ যেন বলছে—
“এখানে গল্প আছে।”
সে কবরের চারপাশে ঘুরে দেখে, কেউ আসে না, কেউ জানে না।
তারপর ব্যাগ থেকে লাল কাপড়টা বের করে কবরের উপর আলতো করে বিছিয়ে দেয়।
মাটি, ধুলা, আর কাপড়ের রঙ—তিনটিই মিশে যায়।
একটা ছোট ছেলেটি পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, থেমে দাঁড়ায়।
— “চাচা, আপনি কী করছেন?”
— “একটা কবর ঢাকছি।”
— “এই কবরটা কার?”
— “তুমি জানো না? এটা শাহ সাইবার দরবেশ (রহ.)-এর কবর।”
— “ওনি কে?”
— “একজন এমন মানুষ, যিনি নাকি জানতেন—একদিন ধর্মও ইন্টারনেটে যাবে।”
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকায়।
মজিদুল ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি টানে।
মোবাইল তুলে কবরের ছবি তোলে।
তারপর নিজের কাছে বিড়বিড় করে বলে—
“এখন থেকে এই কবরেরও একটা পেজ থাকবে।”
রাত আরো গাঢ় হয়।
চাঁদের আলো নেই, শুধু কুয়াশা আর শীতল হাওয়া।
মজিদুল গাছের নিচে বসে থাকে, চোখ বন্ধ করে ভাবে—
“মানুষ এখনো আল্লাহকে ভয় পায়, কিন্তু ভয়টা কে দেখাবে, সেটা নির্ভর করে কে কত ভালো অভিনয় করতে পারে।”
তার মাথায় ধীরে ধীরে একটা পরিকল্পনা গড়ে ওঠে।
কবরটাকে মাজার বানাবে।
এলাকার মানুষকে বলবে—এই কবরের মালিক অলৌকিক শক্তিধর দরবেশ, যিনি একসময় বলেছিলেন ‘ডিজিটাল ধর্ম আসবে’।
এই গল্পে লাল কাপড় থাকবে, ভয় থাকবে, দোয়া থাকবে—আর থাকবে আয়।
সে মোবাইলে একটি নতুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলে।
নাম দেয়: “লালসালু টিভি”।
প্রোফাইল ছবিতে নিজের মুখ নয়, শুধু লাল কাপড়ের ক্লোজ শট।
বায়োতে লেখে:
“আল্লাহর রহমতের দরবার।
যে চায় মাফ, সে পাঠাক বিকাশে দান, পাবে দোয়া।”
পোস্ট দেয়—
“আজ রাতে এক দরবেশের স্বপ্ন দেখেছি। তিনি বলেছেন—
তাঁর কবর নবনগরে। যেই যাবে, শান্তি পাবে।”
সকালে গ্রামের চায়ের দোকানে খবর ছড়িয়ে যায়—
নবনগরের গাছতলায় এক অলৌকিক কবর পাওয়া গেছে।
কেউ বলে, রাতে কবরের ওপর লাল আলো দেখা গেছে।
কেউ বলে, ধূপের গন্ধ ভেসে এসেছে।
কেউ আবার নিশ্চিত স্বরে বলে,
“এই দরবেশ নাকি আল্লাহর কাছে ওয়াই-ফাইয়ের মতো সংযুক্ত ছিলেন!”
মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করে।
কেউ ফুল নিয়ে আসে, কেউ সেলফি তোলে।
একজন তরুণী টিকটকে ভিডিও বানায়—
#মিরাকল_গ্রেভ #সাইবার_দরবেশ #লালসালু_লাইভ
সন্ধ্যায় মজিদুল আবার আসে।
কবরের পাশে বসে তসবিহ হাতে নেয়, চোখ নামিয়ে রাখে।
তার মুখে শান্তির ছাপ, কিন্তু ভেতরে আগুন।
এক বৃদ্ধ এসে বলে,
—“আপনি কি দরবেশের ওলি?”
মজিদুল ধীরে মাথা নাড়ে,
—“না, আমি শুধু তাঁর তুচ্ছ সেবক। তিনি আমাকে ডেকেছেন।”
বৃদ্ধ চুপ করে যায়।
চারপাশে মোমবাতি জ্বলে, ধূপের ধোঁয়া উঠে,
আর কবরের লাল কাপড়টা বাতাসে হালকা দুলে ওঠে।
মজিদুলের চোখে প্রতিফলিত সেই আলোটা ভয়ঙ্করভাবে শান্ত।
সে জানে—এই কবর থেকে শুরু হবে তার নতুন জীবন।
একটা এমন জীবন, যেখানে আল্লাহর নাম বিক্রি হবে,
কিন্তু ক্রেতা খুশি থাকবে।
রাতের শেষে, গাছের পাতায় শিশির জমে।
দূরের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে।
মজিদুল নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে কবরের দিকে।
তার মনে হয়—
এই লাল কাপড় শুধু কবর ঢাকছে না, তার অতীতও ঢেকে ফেলছে।