১৯ অক্টোবর ২০২৫ , ৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫

এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড, জনমনে শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক
আপলোড সময় : ১৮-১০-২০২৫
এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড, জনমনে শঙ্কা হজরত শাহজালাল বিমান বন্দরে আগুন/ছবি বাসস


বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তিন স্থানে পরপর তিনটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলো। এর কোনোটাই ছোট খাট নয়। রাজধানী ঢাকার মিরপুর, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ইপিজেড ও সর্বশেষ দেশের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান বিমানবন্দর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্গো ভিলেজ। তিন স্থানেই পুড়ে ছাড়খাড়। 
ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরপর আগুনের ঘটনায় দেশের মানুষ আতঙ্কে। মিরপুরের গুদাম থেকে শুরু হওয়া এ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ল বন্দরনগরীর সিইপিজেড এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সেই আগুন এসে পৌঁছাল শাহজালাল বিমানবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কার্গো ভিলেজে। ধারাবাহিক আগুন লাগায় প্রশ্ন উঠছে। হঠাৎ এমন কেন?  
শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর আড়াইটার দিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট যোগ দেয়। এরসঙ্গে কাজ শুরু করে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সিভিল অ্যাভিয়েশন, বিজিবিসহ পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা। বিকেল নাগাদ আগুন কন্ট্রোলে এলেও পুরাপুরি আয়ত্বে আনা যায়নি রাত দশটা অব্দি। 
জানা গেছে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানির কমপ্লেক্স ভবনে আগুন লেগেছে। এখানে আমদানি করা বিদেশি পণ্য রাখা হয়। আগুনে সেখানকার প্রায় সব মালামাল পুড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এতে বড় ক্ষতির শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা।

ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) সভাপতি কবির আহমেদ গণমাধ্যমে বলেন, আগুনে বিলিয়ন ডলারের (১০ হাজার কোটি টাকা) বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আমরা ধারণা করছি। এয়ার এক্সপ্রেস ইউনিট পুরোপুরি পুড়ে গেছে।’


বিমানবন্দরের সিঅ্যান্ডএফের (কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এক কর্মচারী বলেন, ‘কার্গোর সব কাপড়চোপড় ও কেমিক্যাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। আগামী দুই-তিন মাস হয়তো আমরা কোনো কাজই করতে পারব না।’
সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি বড় আগুনে পুড়ল গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এলাকা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শর্টসার্কিট ও দাহ্য পদার্থের মজুতই প্রধান কারণ। কিন্তু বিমানবন্দরের ঘটনায় তারা এখনো নিশ্চিত নয় কোন জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত।


রাজনীতিবিদরা যা বলছেন 

পরপর তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকান্ডে তাও আবার এক সপ্তাহের মধ্যে, এতে সাধারণ মানুষ এসব ঘটনা নিছক কাকতালীয় মনে করছেন না। এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় একের পর এক আগুনের ঘটনায় সরকারও অস্বস্তিতে।

সারজিস আলম 

এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগার ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ হিসেবে দেখছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। ফেসবুক পোস্টে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারের দোসরদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে না পারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা। যার ফল বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করতে হবে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বাদ দিয়ে এর পেছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা হোক।’

তারেক রহমান 

আগুনের ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত ও আক্রান্ত সবার প্রতি রইল আমার সহমর্মিতা ও প্রার্থনা। আশা করি সবাই নিরাপদে আছেন।’
আগুনের ঘটনায় দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদের পেশাদারত্ব ও জনসেবার প্রতি নিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসনীয়।
বারবার আগুনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তে জোর দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লেখেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিশেষ করে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কারখানা ও মিরপুরের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জননিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা ও শৃঙ্খলা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে।’


জামায়াত আমির ড. শফিকুর রহমান 


আগুনের ঘটনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার হিসেবে এই বিমানবন্দর শুধু যাত্রী পরিবহনের কেন্দ্র নয়, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। গত এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের দুই স্থানে রাজধানীর মিরপুরে এবং চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায়— ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর আজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কি আকস্মিক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, এ ব্যাপারে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।’
তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরের মতো এমন একটি কৌশলগত স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও নিরাপত্তা ঘাটতির এক স্পষ্ট প্রমাণ। এই ঘটনায় যদি কোনো গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা বা নাশকতার উপাদান থেকে থাকে, তবে তার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা সময়ের দাবি।’

যা বলছেন আজহারি

এদিকে ধারাবাহিক আগুন লাগার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নের ঝড় উঠছে, ‘এসব নিছক কোনো দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত?’ তীব্র আলোচনা-সমালোচনার মাঝে এবার প্রশ্ন তুললেন জনপ্রিয় ইসলামি স্কলার শায়খ মিজানুর রহমান আজহারিও।

শনিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, এ দেশে অগ্নিকাণ্ড যেন এক অবিরাম চক্র— দু-একদিন প্রতিবাদ, মানববন্ধন, মিছিল, গরম টকশো। তারপর আবার সবকিছু নিস্তব্ধ। ঠিক আগের মতোই! অগ্নিকাণ্ডের পর শোক, তারপর সেই চিরচেনা নীরবতা।এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা? কেবল-ই অবহেলা আর অব‍্যবস্থাপনা? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র?’

আজহারি বলেন, ‘প্রথমে মিরপুর, তারপর চট্টগ্রাম ইপিজেড, আজ আবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে। আগুন যেন পিছু ছাড়ছে না। এ দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে কি? প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের রহস্য খুঁজে বের করার সময় এখনই! সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিরপেক্ষ তদন্ত করুন। খতিয়ে দেখুন। যথাযথ ব্যবস্থা নিন।’ 


অন্তর্বর্তী সরকার 

পরপর আগুনের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সব নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।’

এতে বলা হয়, ‘নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।’ 


বেসামরিক বিমান ও পর্যটনবিষয়ক উপদেষ্টা 


বেসামরিক বিমান ও পর্যটনবিষয়ক উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (এইচএসআইএ) কার্গো ভিলেজে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং দ্রুত ফ্লাইট চলাচল পুনরায় শুরুর আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিমানবন্দরটি পুনরায় খুলে দেব।’

বশির বলেন, ‘আপনারা জানেন, বর্তমানে ফ্লাইট চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, সম্ভব হলে রাতেই কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা যায়।’
তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আগুন এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বর্তমানে বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধারে কর্তৃপক্ষ একযোগে কাজ করছে।
‘আমাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হচ্ছে, দ্রুত ও সুশৃঙ্খলভাবে বিমানবন্দরের কার্যক্রম পুনরায় চালু করা,’ বলেন উপদেষ্টা। তিনি আরও জানান, বিমানবন্দরের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব অংশীজন পরামর্শে যুক্ত রয়েছেন।


দেশবাসীর প্রতি দোয়ার আহ্বান জানিয়ে বশির বলেন, ‘আমরা মহান আল্লাহর রহমত কামনা করছি যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি দ্রুত বিমানবন্দরকে পূর্ণ কার্যক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে।’
উপদেষ্টা জানান, আগুন কেবল আমদানি কার্গো এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, রপ্তানি কার্গো অংশ সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ও ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে।’
বশির জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে অংশ নেওয়া কয়েকজন দমকলকর্মী আহত হয়েছেন এবং তারা বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।


তিনি বলেন, ‘যদিও পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে, তবু বিচ্ছিন্নভাবে কিছু স্থানে আগুন জ্বলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম তদারকি করছি।’
উপদেষ্টা পুনরায় বলেন, সরকার দ্রুততম সময়ে বিমানবন্দরের পূর্ণ কার্যক্রম পুনরুদ্ধারে অঙ্গীকারবদ্ধ। 


কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ