
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম করে নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় যাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাবেক ও কর্মরত মিলিয়ে ২৪ জন সামরিক কর্মকর্তার নাম আছে। আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের হওয়া দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩০ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বুধবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে ১৪ জন কর্মরত এবং ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন।
এ দুটি মামলায় সেনা কর্মকর্তাদের বাইরে অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন–– ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। এছাড়া র্যাবের দুইজন সাবেক মহাপরিচালকও আছেন।
আগামী ২২শে অক্টোবরের মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো মামলায় সামরিক বাহিনীর এত বড় সংখ্যক কর্মরত ও সাবেক কর্মকর্তার অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা বিরল বলে তাদের ধারণা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, "৩০ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৪ জন সেনা কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।"
প্রশ্ন উঠেছে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠে তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে কোন আইন প্রযোজ্য হবে?
এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর নিজস্ব আইনে সামরিক আদালতে, নাকি প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করা যাবে- এমন প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।
এদিকে, গত ছয়ই অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এক সংশোধনী এনেছে। ওই সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি সরকারি চাকরিজীবী হলে ওই পদে থাকতে পারবেন না বলে ট্রাইব্যুনালের একাধিক প্রসিকিউটর জানান। সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের এই আইনগত বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের কাছে জানতে চাইলে এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কোনো "মন্তব্য নেই" বলে জানানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবী এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থায় এ ধরনের মামলার আরও উদাহরণ আছে।
তারা জানান, এর আগে ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় তৎকালীন তিনজন সেনা কর্মকর্তা, যারা র্যাবের অধীনস্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
সে সময় তাদের সেনা বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয়েছিলো। পরে সাবেক ওই তিন কর্মকর্তার বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, পেশাগত কাজের সময় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে তার সামরিক আইনে বিচার হবে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য পেশাগত কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে সেটি সামরিক আইনে বিচার হবে। কিন্তু যদি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করেন, তখন তার বিচার সাধারণ আদালতে হতে কোনো বাধা নেই। ইতোপূর্বে এ ধরনের বিচারের একাধিক নজির রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী
গত বুধবার গুমের দুই মামলায় কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত ২৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জারি করা ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর আগে পরোয়ানা জারির আদেশের মাত্র দুইদিন আগে গত সোমবার রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের, ১৯৭৩-এ (২০-সি) সংশোধন করে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি নিম্নলিখিত পদগুলোতে থাকার জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
১. অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া বা থাকার যোগ্য হবেন না।
২. স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত বা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে বা থাকতে পারবেন না।
৩. প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন না। এছাড়া অন্য কোনো সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না অভিযুক্ত ব্যক্তি।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, উপধারা (১)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কোনো ব্যক্তি অব্যাহতি বা খালাসপ্রাপ্ত হলে, ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না।
প্রসিকিউটররা বলছেন, এই প্রজ্ঞাপনের কারণে ফৌজদারি অপরাধের মামলায় যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হবেন, তারা আর সরকারি চাকরির কোনো পদে বহাল থাকতে পারবেন না।
অতীত ইতিহাস যা বলে
সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যে কোনো সেনা কর্মকর্তা বা সদস্যদের অপরাধের বিচার দুটি আইনের আওতাধীন। এর একটি মিলিটারি বা সেনা আইন ও আরেকটি দেশের প্রচলিত আইন। তবে, একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতি এই তিনটি অপরাধে একজন সেনা কর্মকর্তা বা সদস্যের বিচার প্রধানত প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে করতে হবে। কিন্তু, যদি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করে তবে এই তিনটি অপরাধের বিচারও সেনা আইনে করা যাবে। এজন্য সেনা আইনে সেনাপ্রধানকে সে ক্ষমতা দেওয়া আছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, ফৌজদারি অপরাধের মামলা প্রচলিত আদালতে সাধারণত দায়ের করা হয়। ফৌজদারি অপরাধের বিচার হওয়ার কথা সিভিল কোর্টে। তবে সামরিক আইনে বিচার করতে হলে ওই কোর্টের বিচারকের অনুমতি সাপেক্ষে তা সামরিক কোর্টে নিয়ে আসা যায়। এক্ষেত্রে দুইটি অপশনই রয়েছে, বলেন চৌধুরী।
সামরিক বাহিনীর কর্মরত যে কোনো সদস্যের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য। তবে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য বা কর্মকর্তার বিচার প্রচলিত আদালতেই হয়।
এদিকে, ২০১৪ সালে সাত খুন মামলায় যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাদের বিচার সেনাবাহিনীর আইনে করা নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠেছিল। ওইসময় সেনাবাহিনী ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে। পরে অবসরে পাঠানো হয় তাদের।
পরে প্রচলিত আদালতেই বিচার হয়েছিলো ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। কারণ তারা আর ওই বাহিনীর অধীনে ছিলেন না।
সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তা জানান, "যদি সার্ভিং আর্মি বা আর্মড ফোর্সেসের কেউ হয় এবং যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে মানে সিভিল কেইসে জড়িয়ে পড়ে, সেখানে একটা কনকারেন্ট জুরিসডিকশন হয়।" তবে একটি মামলা বা ঘটনার বিচার একাধিক বিচার ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে করা যাবে? মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান এখন গ্রেফতার রয়েছেন।
তিনি জুলাই-অগাস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেছিলেন।
এ বছরের জানুয়ারিতে সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
আইনজীবীরা বলছেন, সেনা সদস্য বা কর্মকর্তাদের বিচার কোন আইনে করা যাবে সেটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাত খুন মামলা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীমের মতে, সংবিধান ও ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ট্রাইব্যুনালে হতে বাধা নেই।
তামীম বলেন, "আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংবিধান দ্বারা প্রোটেক্টেড। সংবিধানেই বলা আছে তা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য যে কোনো আইন এই আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সেই আইন বাতিল হবে, সংবিধান প্রিভেইল করবে। শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে সেই অংশটুকু বাতিল হবে না।"
অর্থাৎ এই আইন সকল ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পাবে।
তিনি জানান, যে কোনো সিভিলিয়ান বা ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের বিচার এই আইন করতে পারবে বলে এই আইনেই উল্লেখ করা আছে।
"ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা দিয়েছে, প্রথম হলো আর্মি, তারপরে নেভি, তারপরে এয়ারফোর্স, পুলিশ, র্যাব, যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এভাবে ক্যাটাগরিক্যালি বলে দিয়েছে। এই আইন তৈরির শুরু থেকেই আর্মিদের বিচার করার পাওয়ার আছে। কর্মরত হলেও আর্মিদের বিচার সেনা আইনে করার কোনো সুযোগ নেই। বিচার এই আইনেই হতে হবে," বলেন প্রসিকিউটর তামীম।
-বিবিসি বাংলা
এ দুটি মামলায় সেনা কর্মকর্তাদের বাইরে অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন–– ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। এছাড়া র্যাবের দুইজন সাবেক মহাপরিচালকও আছেন।
আগামী ২২শে অক্টোবরের মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো মামলায় সামরিক বাহিনীর এত বড় সংখ্যক কর্মরত ও সাবেক কর্মকর্তার অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা বিরল বলে তাদের ধারণা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, "৩০ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৪ জন সেনা কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।"
প্রশ্ন উঠেছে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠে তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে কোন আইন প্রযোজ্য হবে?
এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর নিজস্ব আইনে সামরিক আদালতে, নাকি প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করা যাবে- এমন প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।
এদিকে, গত ছয়ই অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এক সংশোধনী এনেছে। ওই সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি সরকারি চাকরিজীবী হলে ওই পদে থাকতে পারবেন না বলে ট্রাইব্যুনালের একাধিক প্রসিকিউটর জানান। সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের এই আইনগত বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের কাছে জানতে চাইলে এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কোনো "মন্তব্য নেই" বলে জানানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবী এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থায় এ ধরনের মামলার আরও উদাহরণ আছে।
তারা জানান, এর আগে ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় তৎকালীন তিনজন সেনা কর্মকর্তা, যারা র্যাবের অধীনস্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
সে সময় তাদের সেনা বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয়েছিলো। পরে সাবেক ওই তিন কর্মকর্তার বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, পেশাগত কাজের সময় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে তার সামরিক আইনে বিচার হবে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য পেশাগত কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে সেটি সামরিক আইনে বিচার হবে। কিন্তু যদি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করেন, তখন তার বিচার সাধারণ আদালতে হতে কোনো বাধা নেই। ইতোপূর্বে এ ধরনের বিচারের একাধিক নজির রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী
গত বুধবার গুমের দুই মামলায় কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত ২৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জারি করা ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর আগে পরোয়ানা জারির আদেশের মাত্র দুইদিন আগে গত সোমবার রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের, ১৯৭৩-এ (২০-সি) সংশোধন করে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি নিম্নলিখিত পদগুলোতে থাকার জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
১. অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া বা থাকার যোগ্য হবেন না।
২. স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত বা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে বা থাকতে পারবেন না।
৩. প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন না। এছাড়া অন্য কোনো সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না অভিযুক্ত ব্যক্তি।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, উপধারা (১)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কোনো ব্যক্তি অব্যাহতি বা খালাসপ্রাপ্ত হলে, ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না।
প্রসিকিউটররা বলছেন, এই প্রজ্ঞাপনের কারণে ফৌজদারি অপরাধের মামলায় যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হবেন, তারা আর সরকারি চাকরির কোনো পদে বহাল থাকতে পারবেন না।
অতীত ইতিহাস যা বলে
সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যে কোনো সেনা কর্মকর্তা বা সদস্যদের অপরাধের বিচার দুটি আইনের আওতাধীন। এর একটি মিলিটারি বা সেনা আইন ও আরেকটি দেশের প্রচলিত আইন। তবে, একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতি এই তিনটি অপরাধে একজন সেনা কর্মকর্তা বা সদস্যের বিচার প্রধানত প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে করতে হবে। কিন্তু, যদি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করে তবে এই তিনটি অপরাধের বিচারও সেনা আইনে করা যাবে। এজন্য সেনা আইনে সেনাপ্রধানকে সে ক্ষমতা দেওয়া আছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, ফৌজদারি অপরাধের মামলা প্রচলিত আদালতে সাধারণত দায়ের করা হয়। ফৌজদারি অপরাধের বিচার হওয়ার কথা সিভিল কোর্টে। তবে সামরিক আইনে বিচার করতে হলে ওই কোর্টের বিচারকের অনুমতি সাপেক্ষে তা সামরিক কোর্টে নিয়ে আসা যায়। এক্ষেত্রে দুইটি অপশনই রয়েছে, বলেন চৌধুরী।
সামরিক বাহিনীর কর্মরত যে কোনো সদস্যের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য। তবে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য বা কর্মকর্তার বিচার প্রচলিত আদালতেই হয়।
এদিকে, ২০১৪ সালে সাত খুন মামলায় যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাদের বিচার সেনাবাহিনীর আইনে করা নিয়ে আইনি প্রশ্ন উঠেছিল। ওইসময় সেনাবাহিনী ওই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে। পরে অবসরে পাঠানো হয় তাদের।
পরে প্রচলিত আদালতেই বিচার হয়েছিলো ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। কারণ তারা আর ওই বাহিনীর অধীনে ছিলেন না।
সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তা জানান, "যদি সার্ভিং আর্মি বা আর্মড ফোর্সেসের কেউ হয় এবং যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে মানে সিভিল কেইসে জড়িয়ে পড়ে, সেখানে একটা কনকারেন্ট জুরিসডিকশন হয়।" তবে একটি মামলা বা ঘটনার বিচার একাধিক বিচার ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে করা যাবে? মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান এখন গ্রেফতার রয়েছেন।
তিনি জুলাই-অগাস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেছিলেন।
এ বছরের জানুয়ারিতে সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
আইনজীবীরা বলছেন, সেনা সদস্য বা কর্মকর্তাদের বিচার কোন আইনে করা যাবে সেটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাত খুন মামলা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীমের মতে, সংবিধান ও ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ট্রাইব্যুনালে হতে বাধা নেই।
তামীম বলেন, "আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংবিধান দ্বারা প্রোটেক্টেড। সংবিধানেই বলা আছে তা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য যে কোনো আইন এই আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সেই আইন বাতিল হবে, সংবিধান প্রিভেইল করবে। শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে সেই অংশটুকু বাতিল হবে না।"
অর্থাৎ এই আইন সকল ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পাবে।
তিনি জানান, যে কোনো সিভিলিয়ান বা ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের বিচার এই আইন করতে পারবে বলে এই আইনেই উল্লেখ করা আছে।
"ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা দিয়েছে, প্রথম হলো আর্মি, তারপরে নেভি, তারপরে এয়ারফোর্স, পুলিশ, র্যাব, যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এভাবে ক্যাটাগরিক্যালি বলে দিয়েছে। এই আইন তৈরির শুরু থেকেই আর্মিদের বিচার করার পাওয়ার আছে। কর্মরত হলেও আর্মিদের বিচার সেনা আইনে করার কোনো সুযোগ নেই। বিচার এই আইনেই হতে হবে," বলেন প্রসিকিউটর তামীম।
-বিবিসি বাংলা